এডওয়ার্ড হপার বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তববাদী চিত্রশিল্পী হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। তিনি তৈলচিত্র অঙ্কনে খ্যাতি লাভ করেন, ছিলেন জল রং-এচিং-ছাপচিত্রে সমানভাবে পারদর্শী।
হপার ছিলেন একজন আমেরিকান আধুনিক চিত্রশিল্পী যিনি প্রায়ই তার চিত্রকলায় নিঃসঙ্গতা এবং নির্জনতার অনুভূতি চিত্রিত করেছিলেন। তার আঁকা অনেকগুলো চিত্রে কোনো মানুষই ছিল না, এমনকি যেগুলোতে মানুষ ছিল সেগুলোও শূন্যতা এবং নিঃসঙ্গ অনুভূতি নীরব স্থান দখল করে আছে। তার আঁকা ছবিতে সামাজিক দূরত্ব, মানসিক বিষণ্ণতা বোধ, নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব বর্তমান সময়কেই যেন উপস্থাপন করে। যদিও তিনি অর্ধ শতাব্দী আগেই মারা গিয়েছিলেন এবং ইতিহাসের সম্পূর্ণ ভিন্ন যুগে বাস করেছিলেন । আমাদের এই বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতেই হপার আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছেন। যখন আমাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন এই অপ্রত্যাশিত অতিথি “করোনা ভাইরাস” জন্য বিপর্যস্ত, ঠিক তখনি আমরা লক্ষ্য করেছি যে হপারের আঁকা ট্রেডমার্ক পেইন্টিংগুলি ( “অটোম্যাট” (১৯২৭), “নাইটহকস” (১৯৪২),”মর্নিং সান” (১৯৫২), ওয়েস্টার্ন মোটেল (১৯৫৭), সামার ইন্টেরিওর (১৯০৯), সান ইন এম্পটি রুম (১৯৬৩) , হোটেল লবি (১৯৪৩) ) মনে হয় যেন এই সময়ের প্রেক্ষাপটেই রচিত।
“অটোম্যাট” (১৯২৭) -হপারের আঁকা এই পেইন্টিং-এ বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্বের সংকট খুব ভালভাবে চিত্রিত হয়েছে। অটোম্যাট, চিত্রে একজন মহিলা একটি ছোট টেবিলে বসে আছেন; সামনে একটি খালি চেয়ার - যা থেকে বোঝার উপায় নেই যে সে আদৌ কারো জন্য অপেক্ষা করছে কিনা! ইতিমধ্যে তার সামনে কফি এসেছে । তিনি কেবল একটি গ্লাভস সরিয়েছেন, যা ইঙ্গিত দিতে পারে যে তিনি কিছুটা বিভ্রান্ত, তিনি তাড়াহুড়ো করছেন এবং কেবল কিছু মুহুর্তের জন্য থামতে পারেন, অথবা কেবল তিনি বাইরে থেকে এসেছেন মাত্র। কিন্তু পরের সম্ভাবনাটি অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে, কারণ টেবিলে তার কাপ এবং সামনে একটি ছোট খালি প্লেট রয়েছে, যা ইঙ্গিত করে যে সে হয়তো জলখাবার খেয়েছে এবং কিছু সময় ধরে এই জায়গায় বসে আছে। মহিলাটির গায়ে সবুজ কোট এবং তার মাথা, চুল, কান এবং কপাল ডেকে যাওয়া টুপিটি নির্দেশ করে যে এই মহিলাটি একটি বিশাল চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। হপারের অন্যান্য পেইন্টিংগুলির মতো এ চিত্রেও দৃশ্যমান কোনো দরজা নেই। অর্থাৎ এর দ্বারা এটা বোঝা যায় যে মহিলাটি তার নিজের হতাশায় আটকা পড়ে আছে। মহিলাটির বিষণ্ণ, উদ্বিগ্ন, বা দ্বিধান্বিত অবস্থা তার দুটি অবনত চোখ দ্বারাই প্রতিফলিত হয়। চিত্রসমালোচকদের দৃষ্টিতে তিনি যেন তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। রেস্তোরাঁটি বেশিরভাগই ফাঁকা বলে মনে হয় এবং বাইরে রাস্তায় ক্রিয়াকলাপের (বা জীবনের কোথাও কোনও লক্ষণ নেই)। এটি একাকীত্বের অনুভূতিকে আরও স্পষ্ট করে, একইসাথে শহুরে নিঃসঙ্গতাকেও প্রকট করে । ১৯৫৫ সালে, টাইম ম্যাগাজিন অটোম্যাট ছবিকে বিংশ শতাব্দী্র চাপ এবং বিষণ্ণতা সম্পর্কিত একটি গল্পের প্রচ্ছদ চিত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিল।
নাইটহকস্” (১৯৪২)- এডওয়ার্ড হপারের ‘নাইটহকস্’ বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। পেইন্টিংটি ১৯৪২ সালে তৈল চিত্রে আঁকা। পেইন্টিংটিতে একটি স্থানীয় রেস্তোরায় মধ্যরাতের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যার ভিতরে ৪ জন ব্যক্তিকে দেখা যায়; ২ জন পুরুষ, ১ জন মহিলা এবং একজন বারটেন্ডার। হপারের অন্যান্য ছবির মতো এই তৈলচিত্রটিও কিছুটা স্থির ,উত্তেজনা, এবং নীরবতা পূর্ণ। ছবিটিতে হপার রেস্তোরার ভেতরকার আলোর সাথে বাইরের অন্ধকারের বৈসাদৃশ্যের একটি ব্যতিক্রমী ব্যবহার দেখিয়েছেন। এই দৃশ্যের চরিত্রগুলি দেখলে মনে হয় এ ছোট জায়গায়ও তারা একে অপরের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। এই ঘুমন্ত শহরে তাদের চুপচাপ বসে থাকাটা আধুনিক জীবনের সর্বগ্রাসী একাকীত্বকে ধারণ করে যা তাদের মাঝে একটা দূরত্বের সৃষ্টি করে -এই সময়কার সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মতই! যদিও এই ছবির প্রেক্ষাপট ছিল ১৯৪১ এর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালীন পার্ল হারবার আক্রমণের পর। ‘নাইটহকস্’ ছবিটি আধুনিক যুগে মানুষের অস্তিত্ববাদ এবং একাকিত্বের অনুসন্ধান হিসাবে ধরা হয়,। যদিও হপার বলেছেন যে পেইন্টিংটি সম্পর্কে আমি একটি বড় শহরের নিঃসঙ্গতা আঁকছিলাম।” বিখ্যাত নির্মাতা আলফ্রেড হিচকক, ফটোগ্রাফার ইউলিয়াম এগলেস্টন, ডেভিড লিঞ্চ(নির্মাতা, লেখক,চিত্রকর) সহ অনেকে হপার দ্বারা অনুপ্রাণিত । “মর্নিং সান”(১৯৫২) হপার এই ছবিতে আধুনিক শহরে মানুষের অবস্থা তুলে ধরেন এবং আধুনিকতার প্রভাব বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের কারণ হতে পারে তা ফুটিয়ে তুলেন। হপারের মর্নিং সানকে এমনভাবে দেখা যেতে পারে যেন হপার পৃথিবীতে আমাদের নিঃসঙ্গতা তুলে ধরার চেষ্টা করছে। মর্নিং সান যেমন একাকিত্বের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তেমনি এটি আশাবাদেরও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এই চিত্রকলায় একজন মহিলা বিছানায় বসে তার জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোর মুখোমুখি হয় । সে বাহিরে তাকিয়ে আছে যেন মনে হচ্ছে সে তার চিন্তা হারিয়ে ফেলেছে। তার ভঙ্গি, অভ্যন্তরীণতা শূন্যতা একি সাথে জানালার বাইরে বড় শহরের সাথেও একাকীত্বের অনুভূতি জাগায়। এই চিত্রে হপার সূর্যের আলো এবং রুমের আলো ছায়ার বৈপরীত্য দেখানর জন্য কিছুটা বিষণ্ণ বা অনুজ্জ্বল রং ব্যবহার করেছেন। এই সময়ের প্রেক্ষিতে এ ছবি কে আইসোলশানে থাকা কোনো নারী বললে হয়তো ভুল হবে না।
হোটেল লবি (১৯৪৩)হোটেল লবি হপারের আরেকটি উল্লেখ যোগ্য কাজ। দ্রুপদি রীতিতে রচিত এ কাজে নীরবতা,নির্বিকার এবং নাটকীয় অনুভূতির চিত্ররূপ । হপার, যথারীতি, তার রঙের প্রতি যত্নশীল। পেইন্টিংটিতে তির্যক আলো, আবছা অন্ধকার এবং অনমনীয় লাইন ব্যবহার করে একটি অস্বস্তিকর বা গুমোট পরিবেশ খুব সন্তর্পণে তৈরি করা হয়েছে । তিনজন অতিথি ও একজন কেরানী তারা প্রত্যেকে আলাদা দিকে তাকিয়ে আছে এবং তারা মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন । তারা পরস্পর থেকে দূরত্ব বজাই রেখেছেন। ধরে নেওয়া যায় যা এই সময়ের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মতই অনেকটা। এই ছবির জটিল কম্পোজিশান ধারনা করা হয় শিল্পী এডগার দেগা দ্বারা অনুপ্রাণিত।
রুম ইন নিউ ইয়র্ক(১৯৩২) এডওয়ার্ড হপার তার বেশিরভাগ কাজে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন । রুম ইন নিউইয়র্ক চিত্রে হপার নিউইয়র্কের এক দম্পতির কার্যকলাপ চিত্রিত করেছেন। পুরুষ মানুষটি খাঁজ কাটা আরাম চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। তার পাশে লাল পোশাক পরা একজন রমণী, অন্য দিকে মুখ ফেরান এবংদেখে মনে হয় সে সুখী নয়। । সে একটি কালো পিয়ানোর সামনে বসে আলতো ভাবে পিয়ানোর কি ছুঁয়ে আছে। এ ফিগার দুটির অবস্থান এবং তাদের ক্রিয়া কালাপ বা সম্পর্ক দর্শকদের কাছে দুর্বোধ্য রসায়ান মনে হবে। কারন হপার তাদের মাঝে মাঝে চিন্তাশীল স্থিরতা, মৌন অনুভূতি এবং কিছুটা বিষন্নতা সৃষ্টি করেন।। হপার তাদের মধ্যে যে দূরত্ব তা অপ্রতিরোধ্য বলে মনে করেতেন। যদিও এই সময়ে এটিকে কোয়ারেন্টাইনের বিষণ্ণ দিন ও বলা যেতে পারে । ২০২০ সালে, এডওয়ার্ড হপার মারা যাওয়ার অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পরে, সোশ্যাল মিডিয়া তার ছবিগুলিকে কোয়ারেন্টাইন অনুভূতির উৎকর্ষ হিসেবে দেখছে। যদিও হপার একবার মন্তব্য করেছিলেন: “একাকীত্বের বিষয়টি শেষ হয়ে গেছে”। তা সত্ত্বেও,আধুনিক জীবনে তার চিত্র আমাদের বিচ্ছিন্নতার রূপালী আস্তরণ খুঁজে পেতে সাহায্য করে । এই সময়ে আমরা হপার থেকে কি শিখতে পারি, অবিশ্বাস্যভাবে উদ্ভট, কোয়ারেন্টাইন সংস্কৃতি। হপার তার সময়ের সমষ্টিগত চেতনায় প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু অসাবধানতাবশত, তিনি একটি বিশ্বব্যাপী মহামারীর মধ্যেও ২০২০ -এর চেতনাকে দখল করেছিলেন। তার আঁকা ছবি গুলো বর্তমান সময়ের প্রতিফলিত রুপ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর শনিবারের ক্রোড়পত্র ইজেল -এ প্রকাশিত
লেখকঃ জয় প্রকাশ সঞ্জয় দাশ